হাজার বছরের ঐতিহ্য আর বর্ণিল সংস্কৃতির ইতিহাসে সমৃদ্ধ বাঙালী জাতি। এই ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটা বড় পরিচয় বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও রসনা রুচি। অনন্য স্বাদের বাঙালি খাবার আর বাঙালির আতিথেয়তা যুগে যুগে মানুষের মন ভুলিয়েছে। আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে বৈচিত্র্যময় খাবারের সম্ভার, যার সুবাস আর সুনাম রয়েছে সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। বাঙালির এই বৈচিত্র্যময় খাদ্য ও রসনাসম্ভারকে একত্রিত করে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে দেশেরও দেশের বাইরের -ভোজনপ্রিয় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ‘টেস্ট অফ বাংলাদেশ উৎসবের। বাঙালির রসনা ও সংস্কৃতির এই আয়োজন বাংলাদেশের অনন্য স্বাদকে যেমন তুলে ধরবে, একই সাথে দেশের সকল সুস্বাদু খাবারের স্বাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সারাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে। সর্বোপরি, দেশীয় স্বাদের সমাহারে দেশ-বিদেশের মানুষের সম্মিলনে বর্ণিল হয়ে উঠবে স্বাদ ও সংস্কৃতির উৎসব টেস্ট অফ বাংলাদেশ

রসনার গল্পে,

ঐতিহ্যের উৎসবে

আপনি আসছেন তো?

বরিশালের ব্যঞ্জন

বরিশালের বিখ্যাত গুঠিয়ার সন্দেশ দেশব্যাপী পরিচিত। সুমিষ্ট এই সন্দেশের স্বাদ অন্য সন্দেশের থেকে আলাদা ও অতুলনীয়। বরিশালের খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে ঝোলঝালের রান্না, নানা ব্যঞ্জনায় যা হয়ে ওঠে সুস্বাদু। এই অঞ্চলের খাবারের মধ্যে রয়েছে জগৎ বিখ্যাত ইলিশ ও ইলিশের নানা পদ। আমড়া, পেয়ারাও এই অঞ্চলের গর্ব। এছাড়া আরো একটি বিশেষ রন্ধনশৈলী এই অঞ্চলকে আলাদা খ্যাতি দিয়েছে, তা হলো দই, বিশেষ করে মহিষের দুধের দই। এছাড়া নানা ধরণের মিঠার জন্যও এই বিভাগ বিখ্যাত। এই অঞ্চলের স্বাদে যেমন পাবেন মসলার রসনার পরিচয়, তেমনি পাবেন মিষ্টিসমেত আতিথেয়তার ছোঁয়া।

চট্টগ্রামের চমৎকার আহার

চট্টগ্রামের মেজবান জয় করেছে সারা দেশের মানুষের মন। মেজবান আর মেজবানির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আতিথেয়তা মেজবানদারি অথবা অতিথিদের জন্য বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা। মেজবানে সাদা ভাত, গরুর মাংস, গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল ও বুটের ডাল পরিবেশন করা হয়। মেজবানি মাংসের অতুলনীয় স্বাদ এনে দিয়েছে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা। তাছাড়া চট্টগ্রামের শুঁটকি ও বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলের অধিবাসীদের বৈচিত্র্যময় খাদ্যভ্যাস এ অঞ্চলের রসনাকে অধিক মাত্র এনে দিয়েছে। 

ঢাকাই শৈল্পিক ভোজন

ঢাকাই খাবারের তালিকা করতে বসলে হাজার পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে, তবু তালিকা সম্পূর্ণ হবে না। মোঘলাই রসনার বিরিয়ানি, শাহী মোরগ পোলাও থেকে শুরু করে কাবাব, কোর্মা কোপ্তা কালিয়া, কি নেই! এ তো গেল কেবল ঢাকা শহরের কথা, বিক্রমপুরের জগৎবিখ্যাত মিষ্টি ছাড়াও এই অঞ্চলের ইতিহাস ও বর্তমানজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসাধারণ সব খাবার দাবার। ঢাকা অঞ্চলের স্বতন্ত্র একটি খাদ্য হলো বাকরখানি। ঢাকাই বাকরখানির স্বাদ ও গন্ধ এই অঞ্চল ছড়িয়ে সুবাসিত করেছে সারা দেশ ও দেশের বাইরেও।

খুলনার খাতিরদারি

বিস্তীর্ণ শস্যভূমির খুলনা বিভাগের নানা জেলায় নানা খাবারের সমারোহ। মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে সব ধরণের খাবারের ঐতিহাসিক নানা পদ ও রসনার জন্য এই অঞ্চল বিখ্যাত। প্রকৃতির অপার দানে এই অঞ্চল শস্যসমৃদ্ধ, তাই এই অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসেও প্রকৃতির দান পরিলক্ষিত। খুলনার ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা আসলেই সবার প্রথমে আসে চুই ঝালের কথা। চুই ঝালে গরুর মাংস কিংবা খাসির মাংস, একনামে বিখ্যাত! এছাড়াও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মিষ্টান্ন যেমন সন্দেশ, তিলের খাজা, রসগোল্লা ইত্যাদি। এই বিভাগের যেখানেই যাবেন, সুস্বাদু খাবারের সাথে আপ্যায়ন আতিথেয়তা মুগ্ধ করবে সবাইকে।

মিঠে স্বাদের ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ অঞ্চলের রসনা বা খাবারের মধ্যে জগদ্বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এই অঞ্চলের মিষ্টি। মুক্তাগাছার মন্ডা এখন যেকোনো মিষ্টান্নপ্রেমীর জিভে জল এনে দেয়। এই বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রন্ধনশৈলী প্রচলিত রয়েছে। বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর রসনায় এই অঞ্চলের খাদ্যতালিকাও বৈচিত্র্যময়। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত এ অঞ্চলের মিষ্টান্ন। মন্ডা ছাড়াও এই অঞ্চলের ছানার সন্দেশ, নানা মিষ্টান্ন, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি ইত্যাদি দেশের ভোজনবিলাসী মানুষের স্বাদের আকর্ষণ পূরণ করে চলেছে।

রাজশাহীর রাজকীয় রুচি

পদ্মানদী বিধৌত রাজশাহীর রসনা ও স্বাদও রাজকীয় বটে! আমের জন্য বিখ্যাত এই বিভাগের আরেকটি বিখ্যাত খাবার হলো কালাই রুটি, যার স্বাদ অনন্য ও অতুলনীয়। এছাড়াও নাটোরের কাঁচাগোল্লার নাম কে না শুনেছে! সাধারণ খাবারের পাশাপাশি বিশেষ উৎসবের খাবার যেমন পোলাও, কোর্মা বিরিয়ানি বা সুস্বাদু মিষ্টান্ন এর জন্য বিখ্যাত রাজশাহী। এই অঞ্চলের আরেকটি বিখ্যাত খাদ্যাভ্যাস হলো নানা ধরণের নানা স্বাদের মিঠা। সুস্বাদু সব খাবারের সাথে সাথে সম্প্রতি খাবার নিয়ে নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নতুন নতুন স্বাদের সৃষ্টি হচ্ছে এই অঞ্চলে।

রসনার রংপুর

রংপুর বিভাগের রসনায় পাওয়া যায় আবহমান বাংলার স্বাদ। বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী মিঠাই হলো হালুয়া। সারাদশে যেসব বিখ্যাত হালুয়া রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম রংপুরের হাফসি হালুয়া। রংপুরের অতিথি আপ্যায়নের অপরিহার্য উপাদান হলো হাফসি হালুয়া। এই অঞ্চলের আরেকটি অনন্য খাবার হলো শাক দিয়ে তৈরি শোলকা। এছাড়াও আখ, লিচু, ধানের জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলের রসনায় প্রকৃতির স্বাদ পাওয়া যায়। রংপুর শহরের শতবর্ষী খাবারের দোকান সিঙ্গারা হাউজ সহ এই বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় বাঙালি রসনার অকৃত্রিম স্বাদ।

সিলেটের রঙিন স্বাদ

চায়ের দেশ সিলেটের শুধু চা-ই বিখ্যাত নয়, আরো সুস্বাদু সব খাবার রয়েছে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে। সাতকড়ার নাম শুনলেই জিভে জল আসে অনেকের, বিশেষত সিলেটিদের। যারা একবার সাতকড়া দিয়ে মাংস রান্না চেখেছেন, ভাত অথবা খিচুড়ির সঙ্গে সাতকড়ার আচার খেয়েছেন তাদের মুখে লেগে আছে সেই স্বাদ। বিরইন চালের ভাত অথবা পাহাড়ি রসনার স্বাদ এতই অকৃত্রিম যে বিমোহিত করবে যে কাউকে। সাতকড়ার আচার, সাত রঙের চা বা সাত স্বাদের খাবারের সমারোহে সিলেটের রসনা দেশের বাইরেও প্রশংসিত।

বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতি

প্রাচীন বাংলা রন্ধনশৈলী ও খাদ্যভ্যাসের সাথে মধ্যযুগে মিশেছে মোঘল, পারসিক, তুর্কি, আফগানি রসনা ব্যঞ্জনা। এরপর ইউরোপীয় সভ্যতার ফরাসী, পর্তুগীজ, ইংরেজ, ডাচসহ নানা দেশের মানুষের খাদ্যভ্যাস ও রসনা যোগ হয়েছে এদেশের আহার্জে। প্রকৃত বাংলা রন্ধনশৈলীর সাথে বিবিধ সংমিশ্রণে একটি স্বতন্ত্র খাদ্য সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের স্বাদ সম্ভারে। 

ঐতিহাসিক কালের মতোই, আজও দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে আবহমান বাংলার একান্ত নিজস্ব স্বাদ ও গন্ধময় রসনা। আর মানুষের মুখে মুখে, লোককথায় ফেরে সেই সব স্বাদ। এখন সময় এসেছে সেই সব স্বাদ আর রসনার গর্বকে তুলে ধরবার, ছড়িয়ে দেবার।